অধ্যাপক যতীন সরকার: প্রজ্ঞার এক অবসান

       যতীন সরকারের প্রতিকৃতি: গৌতম কুমার দেবনাথ

১৩ আগস্ট ২০২৫, দুপুর পৌনে তিনটায় ময়মনসিংহে চিকিৎসা-পরবর্তী অবস্থানকালে বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও প্রাজ্ঞ শিক্ষক অধ্যাপক যতীন সরকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর প্রস্থান শুধু ময়মনসিংহ নয়, সমগ্র বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।


শৈশব ও শিক্ষাজীবন

১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন যতীন সরকার। শৈশব থেকেই তিনি সাহিত্য, ইতিহাস ও সমাজচিন্তায় আগ্রহী ছিলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠশেষে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।


শিক্ষকতা ও গবেষণা

১৯৬৪ সালে তিনি নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে জ্ঞান, নীতি ও মুক্তচিন্তার পথে উদ্বুদ্ধ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ গবেষক, যাঁর গবেষণা মূলত বাংলা সাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব ও মুক্তচিন্তার ওপর ভিত্তি করে।


সাহিত্য ও বৌদ্ধিক অবদান

যতীন সরকারের লেখনী ছিল প্রখর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবমুক্তির আদর্শে উজ্জ্বল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—


বাংলাদেশীয় কাবিগান

পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন

বাঙালি সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য

মানব মন–মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব

ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ


মোট ৫০টিরও বেশি গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের বৌদ্ধিক ও সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।


মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি

তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, সামাজিক সাম্য ও মুক্তচিন্তার এক নির্ভীক কণ্ঠস্বর ছিলেন। ধর্মভিত্তিক বিভাজন, কুসংস্কার ও মৌলবাদিতার বিরোধিতা করে সমাজে যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন।


সম্মাননা ও স্বীকৃতি

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১০) সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। তবুও তিনি ছিলেন বিনয়ী ও সহজ, যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে আরও উজ্জ্বল করেছে।

প্রস্থান

২০২৫ সালের জুনে গুরুতর আহত হওয়ার পর থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে ওঠে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর আজ ১৩ আগস্ট দুপুর পৌনে তিনটায় ময়মনসিংহে তিনি পরলোকগমন করেন।

উপসংহার

অধ্যাপক যতীন সরকার ছিলেন এক প্রজন্মের পথপ্রদর্শক, মুক্তবুদ্ধির আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এই প্রস্থান কেবল একজন ব্যক্তির নয়, এক বৌদ্ধিক যুগের অবসান।


— চিন্তক

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url