পর্যটনের মানবিক দর্শনঃ বহুত্ববাদী সভ্যতা বিনির্মাণে বৈশ্বিক বিনিময় সংস্কৃতির বিকাশ -স্বাধীন চৌধুরী
ভূমিকাঃ পর্যটন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কাছে একটি অর্থনৈতিক খাত- রাজস্ব আয়ের হাতিয়ার, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু একবিংশ শতকের বাস্তবতায়, যখন বিশ্বজুড়ে চলছে মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতা, জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতা ও সংস্কৃতি-বিমুখতা, তখন পর্যটনের ভূমিকা বিশ্লেষণে প্রয়োজন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
পর্যটন হতে পারে মননশীল, মানবিক এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপের প্ল্যাটফর্ম- যেখানে মানুষ কেবল ভ্রমণ করে না, শেখে, অনুভব করে এবং বিনিময় করে। এরকম পর্যটন একদিকে যেমন বহুত্ববাদী মানবসভ্যতার ভিতকে মজবুত করে, তেমনি নানান সাংস্কৃতিক বিভাজন পেরিয়ে এক বৈশ্বিক নাগরিকতাবোধ নির্মাণে সহায়ক হয়।
পর্যটনের পুনঃসংজ্ঞাঃ স্থান নয়, সম্পর্ক ও মানবিকতা-
ভ্রমণের প্রাথমিক প্রেরণা নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞতা অর্জন। তবে সেই অভিজ্ঞতা যদি কেবল বাহ্যিক থাকে, তা হৃদয় ছোঁয় না, মনন গঠনে ভূমিকা রাখে না, তাহলে বৃহদার্থে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয়তো সম্ভব নয়। পর্যটনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো- স্থানিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয় ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে যাওয়া।
একজন প্রকৃত পর্যটক তাজমহল দেখে মুগ্ধ হয় ঠিকই, কিন্তু তার মার্বেলের স্থাপত্য নয় বরং প্রেম ও শোকের ইতিহাসে যে মানবিক কাহিনি জড়িত, সেটিকেই বেশি উপলব্ধি করে। মাটির ঘরে প্রবেশ করে সে টের পায় পূর্বপুরুষের শ্রম, সংস্কৃতি ও পরিবেশতত্ত্ব- এই বোধই পর্যটনের গভীরতর রূপ।
দেখার শিক্ষাঃ হৃদয়ের চোখে সৌন্দর্য অন্বেষণ-
পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই এক বিশেষ বোধ-দেখার শিক্ষা।
এটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা কেবল বাহ্যিক রূপ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ তাৎপর্য উপলব্ধিতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে গিয়ে চেরি ব্লসমের ছবি তোলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই ফুল ফোটার পেছনে জাপানিদের ঋতুচেতনা, সময়জ্ঞান ও মৃত্যুবোধকে উপলব্ধি করা।
একজন বাংলাদেশী পর্যটক যদি বালিতে গিয়ে দেখে কিভাবে তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছে, তবে সে নিজ সংস্কৃতির প্রতিও আরও গভীর চেতনায় উন্মোচিত হয়।
সুন্দর দেখতে শেখা মানে কেবল চোখ নয়, হৃদয়ের ভেতর তৈরি করা এক অভ্যন্তরীণ জ্যোতি। পর্যটনের মাধ্যমে এই সৌন্দর্যবোধের অনুশীলন মানুষকে করে তোলে মমতাশীল, সংবেদনশীল ও বিশ্বচিন্তায় অভ্যস্ত।
ঐতিহ্য সংরক্ষণঃ পর্যটনের আরেক নাম আত্মপরিচয়ের রক্ষা-
প্রত্যেক জাতিরই একটি সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় থাকে- যা ভাষা, পোশাক, ধর্মীয় রীতি, খাদ্যাভ্যাস ও লোকজ কাহিনিতে প্রতিফলিত হয়। পর্যটন যদি শুধু এই ঐতিহ্যকে পণ্যে রূপান্তর করে উপস্থাপন করে, তবে তা ঐতিহ্যের সংকোচন ঘটায়।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা UNESCO-এর মতে, প্রতিবছর প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যটক কোনো না কোনো সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক উপাদান দেখার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন। এটাই প্রমাণ করে যে, পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দুতে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চাই সাংস্কৃতিক পর্যটনের পৃষ্ঠপোষকতা- যেখানে লোকশিল্প, গান, নাট্যচর্চা, লোকগাথা, অঞ্চলভিত্তিক খাদ্য সংস্কৃতি ও কথ্য ইতিহাসকে উৎসাহ দেওয়া হয়।
এটি কেবল পর্যটকদের আনন্দ দেবে না, বরং স্থানিক জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদাবোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।
বিশ্বনাগরিকত্ব ও আন্তঃসংস্কৃতিক সংযোগঃ
পর্যটন মানুষকে শেখায় বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য- ভিন্ন রঙ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রীতি। ভিন্নতা যে বিভাজনের নয়, বরং এক বন্ধনের হাতিয়ার, সেই শিক্ষা পর্যটনই দিতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যেসব সংঘাত, সহিংসতা বা ঘৃণার রাজনীতি বেড়ে চলেছে, তার বড় কারণ একে অপরের সংস্কৃতি না জানা। পর্যটন এই জানাশোনার, দেখার এবং অনুভব করার একটি মহান শিক্ষা।
যেমন, একজন বাংলাদেশী পর্যটক যখন মরক্কোর কোনো গ্রামে গিয়ে ইসলামি ও আফ্রিকান সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখেন, তখন তাঁর মধ্যে তৈরি হয় এক নতুন সহনশীলতা, উদারতা ও কৌতূহল। এই কৌতূহলই জন্ম দেয় 'বিশ্বনাগরিকত্ব' নামক চেতনার।
সৃজনশীল শক্তির সম্পৃক্ততাঃ পর্যটনের অন্তর্গত শিল্প-
পর্যটনের স্থায়ী এবং গভীর রূপায়ণে চাই শিল্প ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণ।
যদি পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্পে স্থপতি, ইতিহাসবিদ, চিত্রশিল্পী, লেখক, স্থলচিত্র নির্মাতা, লোকগবেষক, পরিবেশবিদ, এবং কবিদের সম্পৃক্ত করা যায়, তবে তা কেবল পরিকাঠামোগত নয় বরং নন্দনতাত্ত্বিক ও মানবিক পর্যটন গড়ে তুলতে সক্ষম।
ফরাসি সাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্তও বলেছেন- 'The real voyage of discovery consists not in seeking new landscapes, but in having new eyes.'
এই 'নতুন চোখ' গড়ে তুলতেই চাই সৃজনশীল শক্তির গভীর সম্পৃক্ততা।
রাষ্ট্রীয় নীতিতে মানবিক পর্যটনের অন্তর্ভুক্তিঃ
পর্যটনকে যদি উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখা হয়, তবে তা নিছক বাণিজ্যিক নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যেমন- সড়ক নির্মাণ, হোটেল নীতিমালা, পরিবেশ সুরক্ষা আইন, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ- সবই এতে সম্পৃক্ত।
রাষ্ট্র চাইলে 'নমনীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটননীতি' প্রণয়ন করতে পারে, যার মাধ্যমে-
স্থানীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণের নিশ্চয়তা থাকবে
পরিবেশ-সচেতনতা প্রচার পাবে
ভিন্ন দেশের পর্যটকদের সঙ্গে সংলাপের সুযোগ বাড়বে,
অঞ্চলভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজম তৈরি হবে,
পর্যটনের মাধ্যমে ‘ডিপ্লোম্যাটিক কালচারাল এক্সচেঞ্জ’ ঘটবে,
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় চাই আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এবং বেসরকারি অংশীদারিত্ব।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশঃ
১. সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির দর্শন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা,
২. ট্যুরিজম বোর্ডে গবেষক, সাহিত্যিক, স্থপতি ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা,
৩. প্রতি বছর 'সাংস্কৃতিক বিনিময় পর্যটন সপ্তাহ' উদযাপন করা,
৪. ইউনেস্কো/সার্ক পর্যায়ে 'লোকসংস্কৃতি ভ্রমণবৃত্তি' চালু করা,
৫. বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনভিত্তিক পর্যটনের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং করা,
৬. পর্যটন কেন্দ্রিক ফিল্ম/ভিজ্যুয়াল আর্টস উৎসব চালু করা,
৭. প্রতিটি জেলা পর্যায়ে 'পর্যটন মানবিকতা কেন্দ্র' গড়ে তোলা
উপসংহারঃ আত্মার ভ্রমণ ও বিশ্বমানবের নির্মাণ
যে সময় আমরা পেরোচ্ছি, তাতে ভ্রমণের প্রয়োজন কেবল ঘুরে দেখা নয়- মানুষকে জানার, বোঝার, ভালোবাসার এক সুনিপুণ অনুশীলন। পর্যটনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এই গভীরতায় পৌঁছাতে পারার ক্ষমতার ওপর।
পর্যটন হোক আত্মার ভ্রমণ- যেখানে মানুষ নিজের সীমারেখা ছাড়িয়ে অপরকে জানার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলে বহুত্ববাদী মানবসভ্যতার স্বপ্ন।
রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি সবাই মিলে এই মানবিক পর্যটন দর্শনকে ধারণ করলে, পর্যটন হবে শুধু আর্থিক নয়- সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও দার্শনিক রূপান্তরের অনন্য হাতিয়ার।
লেখক পরিচিতিঃ কবি,গবেষক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।
ইমেইলঃ swadheenpress@gmail.com
ফেসবুকঃ Swadheen Chowdhury
সেলফোন+হোয়াটসঅ্যাপঃ 01712234163
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url